সেইসমস্ত কোমর্বিডিটি ও রবীন্দ্রনাথ …

Facebook
Twitter
WhatsApp
Email

সংকটকাল। অসুখ। সংক্রমণ। দূরত্ব। মৃত্যুবোধ। এবং আনুষঙ্গিক যা কিছু হয়। এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ কোথায়? আমি স্মৃতি খুঁজি। খোঁজার মধ্যে ওটুকুই যে পড়ে…

তখনও মহামারি আসেনি। পারিবারিক শরিকি সংক্রমণ, ভাঙন আসেনি। ঠাকুমা। রবীন্দ্রনাথকে কাঁপা কাঁপা নিখুঁত সুরেলা কণ্ঠে ধরতেন। ‘এ মণিহার আমায়…’। আমি যতটা না রবীন্দ্রনাথের অনুরক্ত ছিলাম, তার চেয়ে বেশি ঝুঁকে ছিলাম বৃদ্ধার দিকে। কণ্ঠার হাড় দেখা যেত। গোনা যেত। আমার হেমন্ত, মান্না, শ্যামল শোনা কিশোরজীবন, গ্রামাফোনজীবন ‘ধুত্তোর’ বলা চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, সাগর সেনের দিকে সেভাবে ঝোঁকেনি। পঙ্কজ মল্লিক শুনতাম। শোনাতেন হেমন্ত। চশমা পরা প্রৌঢ়। ‘ফুলের বাহার নেইকো যাহার…’। ঠাকুমার ওই মুখটা শুকোতে শুকোতে একদিন জোৎস্নার সন্ধ্যার মতো হেলে পড়ল। একটা ট্রলির ভেতর পাড়া প্রতিবেশীর হাতে বাড়ি ফিরল। আমাদের ফসল তারপর আর ফলল না। পঙ্কজবাবু আর আসেননি। বন্ধুত্ব এসেছিল। ‘চিরদিবসেরই…। পীযূষকান্তি সরকার একটা ক্যাসেটের আয়তের মতো হঠাৎ এসে চলে গেলেন। হাত ছড়িয়ে উদার গলায় আমার রবীন্দ্রনাথ বলার আর কাউকে পেলাম না। কারণ আমরা জর্জ বিশ্বাসের পরে জন্মেছি। সঙ্গীতের প্রাতিষ্ঠানিক কণ্ঠরোধের পরে জন্মেছি। আমরা। আমরা বলতে রাত বারোটার ইংরিজি টিউশন ফেরত চিৎকার, মফস্বল এবং শরীরী বিভঙ্গের পাশাপাশি আলোচনায়, গানে রবীন্দ্রনাথ। মরা বেড়ালের এঁদো গলির পাশে লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ।

Rabindranath Tagore / Untitled / source: www.christies.com

আমার মর্বিডিটি তৈরির পেছনে ওই সন্ধেগুলো, রাতগুলো। সিন্ধু বাঁড়োয়ায় টান লাগলে আমাদের ছন্দ মাখা ‘বেশ তো’ জীবনে এসে গেল গদ্যভাষা। হ্যালুসিনেশন। ‘অকস্মাৎ আমি নেই’। মৃত্যুবোধ। বয়সের সেইসব সিম্পটম কোপাই বোয়ে অনেকদূর চলে গেল। বন্ধুমৃত্যু এল। নারী এল। শরীরী ভাবনা এল। শরীরও। মৃণালিনীকে কিভাবে দেখতেন রবীন্দ্রনাথ? কিশোরী, জ্ঞানদানন্দিনীর সেই মৃণাল এবং কিশোর লেজেন্ডের ভেতর ক্লিশে শরীর কিভাবে এসেছিল? আমাদের দেহখানি, কাম-গন্ধ ময় দেহখানি তুলে ধরলে নিচে পড়ে থাকত সিলেবাস, এইচএস, আর ক্লাস স্ট্রাইকের কামিং-অফ-এজ স্টোরি। আর, ডিরেক্টরের বলার আগেই ক্রেডিট টাইটেলে পর্দায় নামতে থাকা একটার পর একটা বন্ধুর ছবিতে কেউ যেন রেখে আসত ফুল, হাসি, চন্দন, বই – মরণোত্তর। বন্ধুর নাম বলতে নেই। অন্তত যে বন্ধু আর আসবে না, তার নাম তো কোনওভাবেই না। বিনয় মজুমদার আনতে গিয়ে আর ফেরত দেওয়া হল না। ‘তবু তো রবীন্দ্রনাথ আশা আছে, তুমি আছ কলকাতা থেকে দূরে’। সেই বন্ধু, রবীন্দ্রনাথ আর বিনয়।

লাভ ট্রাঙ্গল। কখনও আমি। রবীন্দ্রনাথ সেখানে বাইরে। একটা শীতের রাত। হৃদরোগ। আর আমার মনে পড়া মুঙ্গের। শমী। ‘সমস্তই ভেতর সবই রয়ে গেছে’। ট্রেন থেকে যেতে আসতে সেইসব জোৎস্না পেরিয়ে, জংশন পেরিয়ে আমার বড় হওয়া। বুড়ো হওয়া। রবীন্দ্রনাথ থেকে ব্রাউনিং কত বড়? একজন পারলেন। অন্যজন পারলেন না। মৃণালিনীর সঙ্গে একটা জীবন একসাথে বড় হওয়া, বুড়ো হওয়া, হল না। তার সঙ্গে আমার, হল না। আমার শোকের দায় আমার। সময়ের এদিকে ওদিকে ‘যা ছিল শোক, আজ তাই হয়েছে শান্তি’। মাইথন বাঁধ লাগোয়া তস্য হোটেল। কলেজ এক্সকার্সন। পথিকৃৎ। ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। শারীরবিদ্যা, নেট, ইউজিসি করা সহপাঠীর গলায় এক রাতে হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ। ‘যখন থাকে অচেতনে এ চিত্ত আমার, আঘাত সে যে পরশ তব সেই তো পুরস্কার’। লোকটা জিনিয়াস রে। ওর সলিলোকি‌। আমাদেরই এক বান্ধবী ওকে ভালোবাসে। পথিকৃৎ হাসছে। বাকিটা রাত আমরা ঘুমাইনি। ‘নিঠুর হে, এই করেছ ভালো….’। উত্তর কলকাতার অদ্ভুৎ এক সন্ধ্যায় এক যুবক বৃদ্ধের বাড়ি জর্জ বিশ্বাস এসেছিলেন। দেখেছিলাম। খান্না সিনেমা হলের পিছনে শ্যামচাঁদ মিত্র লেনে ছিয়ানব্বই পেরোনো নকুবাবু। তার মিউজিয়াম। পঞ্চাশ বছরের পুরনো রেকর্ড প্লেয়ারে দেবব্রত। বৃদ্ধ, আমি, পুরনো অ্যালার্ম ঘড়ি, অসুস্থ বৃদ্ধা স্ত্রী, সেলাই মেশিন, টেলিফোন – তন্ময় হয়ে শুনি। রিভার্বারেশন। ‘পথে যেতে যেতে… মৃত্যু আঘাত লাগে প্রাণে’।

স্মৃতি থেকে ফিরি। একসময় সিনেমা প্যারাডাইসোর মতো আনকাট রিলগুলো জড়ো করতে করতে দেখি মৃত্যু, প্রেম, বনেদিয়ানা, উত্তর কলকাতা, নড়বড়ে পিতৃত্ব মিলে রবীন্দ্রনাথ কেমন একটা লাভ হেট চিত্রনাট্যের জন্ম দিয়ে গেছেন। নসিয়া মনে পড়ে। সার্ত্রে। বমিভাব বইতে বইতে একটা সময় সার্ত্রে দেখলেন তার মধ্যে আর নসিয়া নেই। পার্কের ভেতর, বেঞ্চে ঝিমোনো বৃদ্ধের ভেতর, বাসি গোলাপের ভেতর সেসব নসিয়া ছড়িয়ে আছে। আর, সার্ত্রে যেন তার মধ্যে আছেন। আমার ভেতরেও সেভাবে রবীন্দ্রনাথ নেই। অথচ রবীন্দ্রনাথ তো আছেন। বয়স থেকে আরেকটা বয়স, মাঝের টানেল, সুতো, মিসিং লিঙ্ক, আমার আসা যাওয়ার মাঝে তৃতীয় কারও এন্ট্রি, না বলে বেরোনো, এই সমস্ত কোমর্বিডিটির মাঝে রবীন্দ্রনাথ যেখানে সেখানে ঢুকে পড়ে টানটান দাঁড়িয়ে আছেন। আনন্দময় নীরব রাতে। নিবিড় আধাঁরে। আর আমি, ঢুকে গেছি, তাঁর ভেতর। একা…

Facebook
Twitter
WhatsApp
Email