আমার মা তাঁর ঠাকুমার কাছে গল্প শুনতেন; কোপাইয়ের কাছে ডুমুরিয়ার শ্বশুরবাড়ি থেকে ঠাকুমা তাঁর বাপের বাড়ি অযোধ্যা বনকাটি গ্রামের দিকে গোরুর গাড়ি করে যেতেন। শান্তিনিকেতন পোস্ট অফিস মোড়ে তিনপাহাড় তখন এমনটা ছিল না, অনেক ফাঁকা ফাঁকা। ঠাকুমা বলতেন ওই ঢিপির ওপর এক দেড়েল সাধুবাবা বসে ধ্যান করত। সেই সাধুবাবা দেবেনঠাকুর নাকি রবিঠাকুর— মা আজ আর বলতে পারেন না, সবকিছু গুলিয়ে যায়। মায়ের জন্মসালের হিসাব কষে অনুমান করি দেড়েল সাধুবাবা রবিঠাকুর। সেই সময় তো তাঁকে এখানকার মানুষ অমন ভাবেই দেখতে পেত, আর পাঁচটা বোলপুরবাসী সাধারণ মানুষের মতোই। বোলপুর চৌরাস্তার এক দর্জি বানাতেন তাঁর জোব্বা, তাতে নকশা ফোটাতেন নিপুণ হাতে কবির আবদারে।
অজান্তেই তিনি একদিন ‘ঠাকুর’ হয়ে উঠলেন। যে ‘ঠাকুর’ অনেক বৈশাখী তাচ্ছিল্য উপেক্ষা করেও মানুষের মনে থাকে গেছেন। আপামর বাঙালি তাঁকে নিয়ে আজও উৎসব করে, তাঁর সৃষ্টিকে নিয়েই বেঁচে থাকে। এক বৈশাখে তাঁর জন্মদিনের কিছুদিন পরে বেরিয়ে পড়েছিলাম বোলপুর শান্তিনিকেতনে রবি ঠাকুর কেমন আছেন, কোথায় আছেন তার হাল হকিকত দেখতে। সেদিনের যাত্রাপথের কোনও নির্দিষ্ট দিক ছিল না। শুরুটা হয়েছিল শান্তিনিকেতন লাল বাঁধের ওপার থেকে।
একটা সিমেন্টের তৈরি আপাদমস্তক সবুজ রঙের ছাতিম গাছে গুটিকয় পাতার নীচে বসে আছেন সোনালি রঙের দেবেন্দ্রনাথ, ওপর প্রান্তে নোটখাতা, হয়তো বা গীতাঞ্জলি আঁকড়ে দণ্ডায়মান সোনালি রবীন্দ্রনাথ। পাশে এক বিরাট শ্বেত প্রস্তরফলকে লেখা:
নিজের ওপর বিশ্বাস না আসিলে ঈশ্বরে বিশ্বাস আসে না। এই যুগেও বিবেকহীন লোকেদের থেকে নিজেকে রক্ষা করুন। আজ যাকে আমরা লাল-বাঁধ বলে চিনি তাঁর নাম ছিল কবির মোহনপুর। আমি এই আশ্রমে রবিঠাকুরের আদর্শকে সামনে রেখে নিজের জীবন সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। আসুন আমরা সকলে মিলে প্রতিজ্ঞা করি রবীন্দ্রনাথের সবকিছু রক্ষা করার। — রামপ্রকাশ সাউ
ব্যাস! ওইটুকু পড়তে পড়তেই রামপ্রসাদ সাউ হাউ মাউ করতে করতে হাজির হলেন একরাশ অভিযোগ নিয়ে। আমার ক্যামেরা দেখে সাংবাদিক ঠাওরে আশঙ্কা প্রকাশ করলেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মাপজোক করে যে রাস্তা বানাচ্ছেন তাতে তার এই আশ্রম সহ ভিটে মাটি উপড়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা এবং সেটা ‘রক্ষা’ করতে ঢাল করলেন ওই কবিগুরুর মূর্তি, যার ওপর সাউ মহাশয়ের অগাধ বিশ্বাস। সালটা ছিল ২০১০। আজ পিচ ঢালা উঁচু রাস্তা হয়ে গেছে। কিন্তু অক্ষত থেকে গেছে সাউ মহাশয়ের বাণী খোদিত শ্বেতপাথরের ফলক সহ ‘ঠাকুর’ মূর্তি দু’টি। সেযাত্রায় ‘ঠাকুর’ই বাঁচিয়ে ছিলেন নির্ঘাৎ।
সেখান থেকে পৌঁছে ছিলাম রতনপল্লি ডেইলি ব্রেডের কাছে তান হস্টেলের সামনে এক চায়ের দোকানে। যেটার পাশেই কংক্রিটের ইলেকট্রিক পোষ্ট আড়াআড়ি ভাবে ফেলে বসার ঠেক, পিছনের দেওয়ালে কিছুটা অংশ চুনকাম করে কালো রেখাচিত্র। সবাইকে আলাদা করে চিনতে না পারলেও রবি ঠাকুর ঠিক ধরা দেন।
আবার ওই রাস্তাতেই সোজা এগিয়ে বাবলু দা’র লেডিস ও জেন্স সেলুন ছিল। নিম গাছের নীচে বেঞ্চ পাতা, অপেক্ষমান খদ্দেরদের জন্য। সেখানে বসে খানিক লক্ষ্য করলেই কাঁচা মাটির বৃষ্টিতে গলা দু’টি লাল রাঙা মুর্যাল চোখে পড়ত। একটি রামকৃষ্ণ,অপরটি?? ওঃ ! রবি ঠাকুর তো!! বিশ্ব-ভারতী সমবায়ের পিছনের দিকে যে বাজার;
সেখানেই ছিল ওই সেলুন, বর্তমানে সেটির অস্তিত্ব নেই। শুধু থেকে গেছেন রবি ঠাকুর মাঝি পাড়ায় সুন্দর করে নেকানো মাটির বাড়ির সাদা দেওয়ালে। এক বোলপুর কলেজের পড়ুয়া ছেলের তুলির টানে।
আজকের এই আবহে যখন রবির গান গেয়ে রোদ্দুর আলোকপ্রাপ্ত হচ্ছে তখন আমার এই ছোট্ট মফঃস্বল শহরটিতে বেশিরভাগ মানুষই রবীন্দ্রনাথকে মনের কোণে পরম যত্নে লালন করেন। রবি ঠাকুর যে আমাদের ঘরের লোক, তাঁর সাথে নিত্যদিনের সহবাস। সেজন্যই তো এই শহরের অধিকাংশ ঘরেই রবীন্দ্রনাথের একটা ছবি দেওয়ালে টাঙানো থাকে। অনেকেই আবার বাড়িতে একটু জায়গা থাকলে তাঁর একটা মূর্তি বসিয়ে ফেলে। ব্যাস, কিছুদিন পর সেটা হয়ে যায় পরিবারেরই এক বয়স্ক সদস্য। অবহেলায়, অযত্নে পড়ে থাকে বাড়ির উঠোনে। ২৫শে বৈশাখ একটা ফুলমালা, যা শুকিয়ে গেলে কবিমূর্তি নিজেই কোনও এক কালবৈশাখীর ঝড় বৃষ্টিতে সেটাকে উড়িয়ে দিয়ে নিজেকে সাফ সুতরা করে নেন।
প্রমাণ স্বরূপ বোলপুর সুপার মার্কেটের সামনের লেখনী হাতে দণ্ডায়মান মূর্তিখানি খুঁজে পাই, ঠিক পিছনেই কাপড়ের দোকানের ফলকেও কবির বাণী সহ রেখাচিত্র। স্মৃতি হাতরে মন ফিরে যায় ছেলেবেলায়। তখন কোথায় সুপার মার্কেট, বিচিত্রা সিনেমা হলের সামনে ধূধূ রুক্ষ প্রান্তর- ডাকবাংলোর মাঠ। সেই মাঠে বিচিত্রা সিনেমা হলের দিকে ছিল এক মানুষ সমান সিমেন্টের বেদির ওপর এক নতশির রবি মূর্তি। ছেলেবেলায় বন্ধুরা বলেছিল বাজ পড়ে নাকি মূর্তিটি অমন কুঁজো হয়ে গেছে।
ওটা দেখলেই মনটা কেমন কষ্টে ভরে উঠত। অনেক পরে জেনেছি মূর্তিকারের নাম ও মূর্তি তৈরির নেপথ্য কাহিনী। যখন ওই রবিমূর্তিটির খোঁজ করলাম, দেখি সেটি আর সেখানে নেই। এখনকার প্রাচীর ঘেরা বোলপুর স্টেডিয়াম আর সুপার মার্কেটের মাঝের জায়গাটিতেই তো তখন ছিল মূর্তিটি! এদিক ওদিক খোঁজ নিয়ে জানলাম সেটি এখন লোকচক্ষুর আড়ালে ডাক বাংলোর সুউচ্চ প্রাচীরের ভিতরে সুরক্ষিত করে রাখা হয়েছে। অতঃপর তাঁকে দেখতে গেলুম। দেখি গেটে ইয়া বড়ো তালা । গেটের ফাঁক দিয়ে শীর্ণকায় কিছু গাছের তলায় আলো আধারিতে বিমর্ষ কবি মূর্তি দৃশ্যমান। ঢুকে পরলাম গেট টপকে। কাছে যেতেই সদ্য ২৫শে বৈশাখের শুকনো ফুলমালা গলায় রামকিঙ্করকৃত কবি মূর্তির রেপ্লিকার প্রতি অবহেলা দেখে আবার মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। মনে হল কবি যেন একটু আদর চাইছেন, একটু যত্ন। ঠিক তখনই মনের মাঝে উদয় হল অপর এক রবি মূর্তি, জোড়হাত করে কাতর মিনতি করছেন। ওই মূর্তি কোথায় যেন দেখলাম? হ্যাঁ, মনে পড়েছে রতনপল্লিতেই একটা পাখির খাঁচার পাশে।
ঠিক যেন খাঁচার বন্দি দশা শেষ করে করজোড়ে রবি ঠাকুর আমাদের কাছে জানতে চাইছেন আমাকে নিয়ে আর কত? ওদিকে শ্যামলি দী’র বাড়ির বাগানে লতাপাতার মাঝে লুকিয়ে আছে সুধীর খাস্তগীরকৃত রবীন্দ্র প্রতিমূর্তি… আছে; আরও আছে… জার্মান ধাবার সামনে শৌচালয়ের ছাতে, শ্যামবাটিতে গ্রিলের ফাঁকে… আড়ালে আবডালে।
ক্রোধ কি তাঁর হয়নি? হয়েছে বৈকি। তাই তো আমার কুটিরের সাঁওতালি রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিজ্ঞাপনে মোড়া চা গুমটির দোকানের সামনে যে রবি মূর্তি, চোখে মুখে রাগের সেকি বহিঃপ্রকাশ! আচ্ছা, শহরময় এই যে মন গড়া উচ্চতা, অনুপাত ও অভিব্যক্তির
বিমূর্ত যেসব রবিমূর্তি, তারা তৈরি হয় কোথায়? খুঁজতে গিয়ে পৌঁছে ছিলাম কালিসায়রের আগে ‘দাস কংক্রিট’ এর সামনে। সেখানে হরেক মাপের রবি মূর্তি দণ্ডায়মান। বিভিন্ন তাদের মুখাবয়ব। নিখুঁত (!) না হলেও একটুও কষ্ট না করে বুঝে ফেলা যায় কার মূর্তি। খুঁত বিচার করতে বসলেই মূর্তির আত্মা তাকে ত্যাগ করে পালায়। তখন তাঁকে খুউব পরিচিত এক বুড়ো বলেই মনে হয়!
একটু এদিক সেদিক লক্ষ্য করলেই নজরে আসে দ্বি-প্রাহরিক নিদ্রারত মশলা মুড়িওয়ালার গাড়িতে শাহরুখ খানের সাথেই রবীন্দ্রনাথের ছবির সহাবস্থান। কিংবা ফুটপাতে দোকানি তাঁর পশরা সাজিয়েছেন শুধুমাত্র একটি ছবির ভরসায়। হমুমান জী, রাধাকৃষ্ণ কিম্বা লোকনাথ বাবার সাথেই আমাদের আপদে বিপদে সুখে দুখে সকলেই তাঁর শরণাপন্ন হই। কিন্তু তাঁকে আমরা কেমন রাখলাম সে কথা কি একবারও ভাবি?
শান্তিনিকেতনের অদূরেই আদিত্যপুর। সেখানেই ছাঁচে তৈরি হয় এক-একবারে কয়েক শো পুতুল রবীন্দ্রনাথ, বাজারের চাহিদা অনুযায়ী। লাল মাটির টেরাকোটা আবক্ষ রবি ঠাকুর খয়েরি- সোনালি রঙে রাঙিয়ে চলে আসে শান্তিনিকেতনের পর্যটন বাজারে। যার দাম ক্রেতার ধরন আর সময়ের সাথে সাথে কমে বাড়ে শুনেছি। ছেলেবেলায় দেখতাম পূর্ণাঙ্গ আর আবক্ষ দু’ধরনের পাওয়া যেত। কালের নিরিখে পূর্ণাঙ্গ আজ শুধুই আবক্ষে এসে ঠেকেছে। একই ছাঁচের বহুল ব্যবহারে রবি-পুতুল আজ বিকৃত। বিকৃত বলতে মনে পড়ে গেল ভুবনডাঙ্গার পর্যটন বাজারে পাওয়া যেত কাঠের ডালে খোদাই করা রবীন্দ্রনাথ-সদৃশ কিছু একটা, মনে মনে নাম দিয়েছিলাম রকেট রবীন্দ্রনাথ। দোকানে উকি ঝুঁকি দিতেই আরও কিছু আবক্ষ !!
এক গভীর রাতে ওই বাজারে আগুন লেগেছিল। পুড়ে ছাই বাঁশ-পলিথিনে ঘেরা রবীন্দ্র পণ্য ঠাসা বেশ কিছু দোকান। দমকল এসেছিল রাতেই, আগুন নিভতে নিভতে সকাল। ক্যামেরা নিয়ে দৌড়ে গেলাম, দেখি সব ছাড়খার। তারই মাঝে কিছু ভাঙা রবীন্দ্র পুতুল তখনও তাকে থেকে গিয়েছে। জীবনের নানান বাঁকে দুঃখে বেদনায় দগ্ধ কবির মনটার রূপকল্প হয়ে। আজ নিজেকে প্রশ্ন করি— পারলাম কি তাঁকে ভালো রাখতে— ভালোবাসতে?