চিরসখা হে…

Facebook
Twitter
WhatsApp
Email

সহজ পাঠের দিনগুলোয় আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয়। তখন আমার কত আর বয়স, চার পাঁচ হবে! আমার সেই বয়সের মন, কীভাবে যে তাঁর লেখার সঙ্গে মিলে যেত, বুঝতে পারতাম না। মনে হত তাঁর কথাই যেন আমার না বলা কথা। তাই একদিন যখন আনন্দ পাঠশালায় ক্লাসের জানলার ধারে বসে মৌসুমী মাসি আমাদের পড়ালো তাঁর কবিতা, ‘কতদিন ভাবে ফুল উড়ে যাব কবে/ যেথা খুশি সেথা যাব ভারি মজা হবে/ তাই ফুল একদিন মেলি দিল ডানা/ প্রজাপতি হল তারে কে করিবে মানা!’ সেদিন মাসিকে জিগ্যেস করেছিলাম, ‘ফুল কী করে উড়ে যায় গো?’ মাসি উত্তরে বলেছিল, ‘ফুল তো ওড়ে না। ফুলের মন উড়ে যায়।’ শুনে মনে হল, ফুলের মনটাই তো আমার মন। আর সে মনের ইচ্ছের হদিশ যে পায়, সে-ই তো পারে আমার বন্ধু হতে।

তাই সেই ছোট্টবেলা থেকে রবি ঠাকুরের সঙ্গে আমার এক সহজ বন্ধুতা তৈরি হয়েছিল। তাঁর লেখায়, গানে, ভাবনায় বারবার যেন নিজেকে খুঁজে পেয়েছি । আনন্দ পাঠশালার পর আমি যেদিন পৌঁছলাম পাঠভবনে, সেদিন থেকে আমার জীবনে তাঁর উপস্থিতি যেন আরও প্রবল হয়ে উঠল! আশ্রম বিদ্যালয়ের গাছপালা, আকাশ, মুক্ত প্রাঙ্গন আমার হাত ধরে, চিনিয়ে দিল তাঁকে। যিনি যন্ত্র নয়। যিনি মানুষ। যিনি সৌন্দর্যের ভিতর দিয়ে সারাটা জীবন খুঁজেছেন মুক্তি। বলেছেন, ‘সৌন্দর্য এবং সুব্যবস্থা মনের জিনিস। সেই মনকে মুক্ত করা চাই।’

শান্তিনিকেতন আমাকে শুধু যে পড়াশোনা শিখিয়েছে, তা তো নয়, পড়াশোনার পাশাপাশি শিখিয়েছে প্রকৃতিকে ভালবাসতে। সে ভালবাসার জোরেই গ্রীষ্মের দাবদাহে গাছের নীচের এক টুকরো ছায়াতে পড়াশোনা করতে অসুবিধে হয়নি আমাদের। বৃষ্টিতে ভিজে গেছে ধুলোয় পাতা আসন। ভিজেছি আমরাও। তাতে অভিযোগ হয়নি কোনও। বরং আনন্দ হয়েছে। আসলে প্রকৃতি আর মানুষের এই মিলেমিশে যাওয়ার শিক্ষাই দিতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। একেই বোধহয় বলেছিলেন পরিপূর্ণ ভাবে বেঁচে থাকার শিক্ষা।

শুধু স্কুল নয়। বাড়ির পরিবেশেও ছোটোবেলায় আমি খুঁজে পেয়েছিলাম আমার এই বন্ধুটিকে। কত কত দুপুর আমার খোলা জানলার পাশে ‘ডাকঘর’ পড়তে পড়তে কেটে যেত…। জানলা দিয়ে অমলের মতো শুধুই অপেক্ষা করতাম। ভাবতাম, এই বুঝি এল দইওয়ালা! পাঁচমুড়া পাহাড়ের তলায় যার বাড়ি। আমার কল্পনায় তখন বয়ে যেত শামলী নদী…। আবার পরক্ষণেই মনের ভিতর বদলে যেত আমার ভূমিকা। মালিনীর মেয়ে সুধা, সে যেন আমিই। যার রোজ বেলা বয়ে যায় ফুল তুলতে তুলতে। যে যেতে যেতে বলে যায় ফুল নিয়ে সে ফিরবেই। কিন্তু অমল হারিয়ে যায় একদিন! তবু সুধা ফুল নিয়ে ঠিক ফিরে আসে। সেই সুধা হতে আমার ইচ্ছে করত, যে কখনও ভোলে না অমলকে। ভুলতে পারে না।

আমার মনে পড়ে, মেঘ বৃষ্টির দিনে আমি মাঝে মাঝে কানাই মাস্টার সাজতাম। আমার বেড়ালছানা ছিল না। তবে একটা কুকুর ছিল কালো রঙের। রাস্তায় থাকত। কখনো-সখনো আসত আমার কাছে। চেহারা দেখে বুঝতাম ঠিকমতো খাবার জোটে না! ওর সঙ্গেই চলত আমার পড়া পড়া খেলা। আমার মাস্টারির অত্যাচার সে ভালোমানুষের মতো সয়ে নিত ঠিকই, তবে সুযোগ পেলেই কানাই মাস্টারের সেই বেড়াল ছানাটার মতো কোথায় যে যেত, আর দেখা পেতাম না! কিন্তু একদিন থেকে সত্যি সত্যিই তার আর দেখা পেলাম না। একদিন না, দু-দিন না, কোনোদিন না…। তারপর যতবার আমি রবি ঠাকুরের ‘ছেলেটা’ পড়েছি, ওই কালো রোগা কুকুরটার কথা মনে পড়েছে খুব।

কিন্তু ছেলেবেলায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের যে চেহারা ছিল, বড়োবেলায় দেখলাম তার অনেকটা বদলে গেছে । ছেলেবেলায় তাঁর লেখা, গান, ভাবনা সব যে বুঝতাম এমনটা নয়। কিন্তু বড়ো হলাম যখন, মনে হল তাঁকে হয়তো আরও বেশি করে বুঝতে পারছি। অনুভব করতে পারছি। তাঁর লেখার ভিতর দিয়ে আবিষ্কার করলাম একটা নতুন মানুষকে। যে শুধু বন্ধু নয়। যে আমার আশ্রয়।
আমার এই বড়োবেলার অনেকটা জুড়ে আছে তাঁরই গীতবিতান। সেখানে আমি দেখেছি অন্য এক রবীন্দ্রনাথকে। যে ভালবাসতে শেখায়। শেখায় আত্মত্যাগ। তাই তো বিরহে বিলীন হয়েও বলেছেন ‘যদি আর-কারে ভালোবাস, যদি আর ফিরে নাহি আস, / তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও, আমি যত দুখ পাই গো ।।’ নিজের ভাগে দুঃখ থাক, সুখ থাক অন্যের ভাগে। এ কথা এত সহজে আর কেউ বলেনি আমাকে। তাই আমার সুখের দিন ছাপিয়ে যত আঁধার এসেছে জীবনে, তত আমি একা একা ফিরে গেছি তার গানের ভিতর। গীতবিতানের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে জীবনের না-পাওয়ার দিকে চেয়ে কতবার যে বলেছি, ‘বড়ো বেদনার মতো বেজেছ তুমি হে আমার প্রাণে’…। তবু ভরসা থেকেছে রবীন্দ্রনাথেই। জীবনে কত কিছুই না আমরা হারাই! ফুরোয় মুহূর্ত, ছেড়ে যায় মানুষ। কিন্তু এক রবীন্দ্রনাথই আছেন, যার যাওয়া নেই। যে শুধুই থাকতে আসেন। বিজন রাতে আজও তাই অস্ফুটে বলে উঠি, ‘জানি জানি বন্ধু জানি / তোমার আছে তো হাতখানি’।

রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট নারী চরিত্রদের ভিতর এই বড়োবেলায় একটু একটু করে মিশে গেছি নিজে। মুগ্ধ হয়েছি ওদের ভিতরের শিক্ষা ও বুদ্ধির আলো দেখে। ওরা ভালবাসতে জানে, বিরহে কাঙাল হতেও জানে। আবার উঠে দাঁড়াতেও জানে। জীবনের ছোটো ছোটো মুহূর্তের ভিতর বড়ো হয়ে দেখা দেয় ওদের সংবেদনশীল মন। তাই তো কখনও চারুলতার মতো আমি নিভৃতে রচনা করতে চেয়েছি আমার নন্দন কাননকে। কখনও বা স্বপ্ন দেখেছি একটা বাগানের। সেকালের রাজকন্যার মতো সেই বাগানে দু-বেলা নিজে হাতে জল দেব। বাগানের মধ্যে থাকবে একটা ছোটো ঝিল ‘আর তাতে নীলপদ্ম দেব, আমার অনেক দিন থেকে নীলপদ্ম দেখবার সাধ আছে।’ –এ যেন চারুর কথা নয়, এ আমারই ইচ্ছের কথা।
বিকেলের নিভে আসা আলোয় এক একদিন অকারণেই আমার সঙ্গী হয়েছে ‘শেষের কবিতা’। কতবার যে নিজেকে মনে মনে ভেবেছি লাবণ্য! অমিতর সঙ্গে যার চলার পথ বন্ধনহীন গ্রন্থি দিয়ে বাধা। যে ভালবাসাকে কোনও প্রতিষ্ঠানে বা চিহ্নে আটকে রাখতে চায় না। সে কেবল বলে যায়, ‘আমার প্রেম থাক নিরঞ্জন। বাইরের রেখা বাইরের ছায়া তাতে পড়বে না।’

গল্প উপন্যাসের বাইরেও যেন রবীন্দ্রনাথকে পড়তে পড়তে কখনও বা তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে ঢুকে পড়েছি! ‘জীবনস্মৃতি’র পাতায় দেখেছি তাঁর ছেলেবেলা। তাঁর বড়োবেলা পড়ে জেনেছি কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যুই না এসেছে জীবনে! তবু ভেঙে পড়েননি তিনি। মৃত্যুকে জয় করতে করতেই রবীন্দ্রনাথের এগিয়ে যাওয়া। সে এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্র বারেবারে শেখাতে চেয়েছেন আমাদের। বলেছেন, জীবনে ভালো আর মন্দ, যাই আসুক না কেন, সত্যকে যেন সহজে গ্রহণ করতে পারি।

আসলে রবীন্দ্রনাথ নেই বলেই বোধহয় তিনি আজও বেশি করে আছেন আমাদের মাঝে। তাঁর দিয়ে যাওয়া শিক্ষার আলোয় আমরা যারা বড়ো হয়ে উঠেছি, তাদের জীবনের ঝড় জলে রবীন্দ্রনাথই তো এখনো একমাত্র ভরসা। আমার জীবনেও তাই। সেই সহজ পাঠের দিনগুলো থেকে এই আজ অবধি খুব সহজেই আমার যাপনে মিশে গেছেন তিনি। তাই আজও যখন তাঁর লেখায় আমি নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাই অথবা যখন আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে একমাত্র তাঁরই লেখা, তখন তাঁকে বন্ধু বলে ভাবতেই বেশি ভালো লাগে। এই বন্ধুতার কাছে আমি বড়োবেলায় চুপ করে বসি, আর মনে মনে শুধুই বলি, ‘চিরসখা হে, ছেড়ো না মোরে।’

Facebook
Twitter
WhatsApp
Email